১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

করোনায় বরিশালে শিশুদের সাথে প্রতারণা, সমাজসেবা অধিদপ্তরের হরিলুট

আপডেট: এপ্রিল ২২, ২০২০

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন

শাকিব বিপ্লব, (সহযোগিতায় হাফিজ স্বাধীন) :

বরিশাল সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাভূক্ত শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে করোনা দূর্যোগে হরিলুটের সুযোগ এসেছে এমনটি সেখানকার বর্তমান হালচিত্র প্রমাণ করে। করোনা থেকে সাবধানতায় সামাজিক দূরত্ব এবং খাবারের মান উন্নতকরণসহ ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার পরিবেশনে নির্দেশনা থাকলেও কোনটিই মানা হচ্ছে না। নিম্নমানের চাল-ডালের সাথে হদুলের মিশ্রনে সেখানে সপ্তাহে তিনদিন পরিবেশন করা হচ্ছে খেচুরী। ভিটামিন সি-যুক্ত খাবারের বালাইতো নেই। উপরন্ত শিশুদের দিয়ে প্রখর রৌদ্দে মাঠে কাজ করানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিয়ে খোদ ওই দপ্তরেই কর্মকর্তাদের মাঝে বিভাজন সৃষ্টির আভাস পাওয়া যায়।

চাকুরী ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধাসহ আর্থিক লাভবান হওয়ার প্রলোভনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বৃহৎ অংশ প্রকল্প উপ-পরিচালকের পক্ষ নিয়েছে। বিপরীতে ভেতরের গোপনীয়তা বাহিরে যেনো না যেতে পারে এজন্য বিশেষ দপ্তরের ব্যক্তিকে অন্য শাখার দেখভাল দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অনাথ শিশুদের সাথে প্রবঞ্চনার এই কাহিনী চার দেয়াল ভেদ করে মিডিয়ার দরজায় এসে পৌছেছে।

প্রকল্প উপ-পরিচালক বাসু দেবনাথ এই অভিযোগ অস্বীকার করে এমনভাব প্রকাশ করলেন যেনো তিনি কিছুই জানেন না (!)।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একটি নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, গোটা দুর্নীতির নাটের গুরুই হচ্ছেন এই প্রকল্প উপ-পরিচালক। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, একজন আয়ার ক্ষমতা সেখানে এতেটাই উচ্চতায় পৌছেছে যে, উপ-পরিচালকের পরেই যেনো তার স্থান।

প্রাপ্ত খবরের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, করোনা ভাইরাসের প্রাদূর্ভাব দেখা দেয়ার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বরিশাল সমাজসেবা অধিদপ্তরকে পথ শিশুদের সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রেগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ খাবারের মান বৃদ্ধির পাশিপাশি ভিটামিনযুক্ত খাবার পরিবেশনে নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু পূর্বের চিত্রের সাথে বর্তমানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সপ্তাহে নির্ধারিত তিনদিন বরাদ্দ দুপুরের খাবারের তালিকায় থাকা খেচুরীর মান পরীক্ষা করলেই শহরের রূপাতলীস্থ শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় কেন্দ্রের দুর্নীতির নমুনা সহজেই অনুমান করা যায়। নিম্নমানের চাল ও ডালের সাথে হদুল মিশ্রন করে তৈরি খেচুরী সেখানকার শিশুরা অনিচ্ছা সত্বেও খেতে বাধ্য হচ্ছে।
সপ্তারের দুইদিন মাছ ও মাংস খাবারের তালিকায় থাকলেও বিশেষ করে মাংস দেয়া হচ্ছে পোল্ট্রি মুরগি। কখনো কখনো গুরুর মাংস সরবারাহ করা হলেও তার সংখ্যাগত দিন একেবারেই কম। ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার লেবু বা মাল্টা খাবারের ম্যানুতে থাকা বাধ্যবাকগতা থাকলেও সেই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। তবে দুই একদিন মাল্টা সরবারহ করা হয় বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু যে পরিমাণ এই ফল দেয়ার কথা তার থেকে সংখ্যাগত দিক হাস্যকর বটে।
সেখানে কর্মরত একজন আয়ার দাপট শুনে রীতিমত ভিমরি খাওয়ারমত অবস্থা। সীমা বেগম নামক এই আয়া একাই একশ, তিনিই নির্দেশনা দেন অনেক কর্মকর্তাদের কোন পথে হাটতে হবে। প্রখর রৌদ্দের মাঝে শিশুদের মাঠে এনে জোরপূর্বক কাজ করানোর অভিযোগও রয়েছে। সরেজমিনে গেলে এই চিত্র দেখা গেছে।

সেখানকার একটি সূত্র বলছে, ঠিকাদার রোমানের সাথে প্রকল্প উপ-পরিচালক বাসু দেবনাথ সমন্বয় করে পথশিশুদের এই আশ্রয় কেন্দ্রের লুটপাটের রাস্তা তৈরি করেছে।
অপর একটি সূত্র বলছে, সেখানকার গোডাউনে মালামালের মান সম্পর্কিত বিষয় যেনো বাইরে প্রকাশ না পায় সেই জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনিফার সুলতানাকে সরিয়ে দিয়ে এডুকেশন শাখায় রাখা হয়েছে। যদিও জেনিফার সুলতানা ইতোপূর্বে একই সাথে এডুকেশন ও স্টোরের দায়িত্ব পালন করতেন। সেখানে এখন উপ-পরিচালকের আস্তাভাজন রত্ন রায়কে এডুকেশনের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে স্টোর দেখভালের।
এ প্রসঙ্গে আজ বুধবার রাতে সেলফোনে রত্ন রায়ের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মিডিয়াকে এরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অনুমানে এক পর্যায়ে কৌশলে কথাপথনের দীর্ঘতা তৈরি করলে মুখ গলিয়ে স্বীকার করে নেন উপ-পরিচালক বাসু দেবনাথের কথায় চলতে হচ্ছে। অবশ্য ভিটামিন সি-যুক্ত খাবারের তালিকায় শিশুদের প্রথম দিন মাল্টা সরবারাহ করা হচ্ছে বলে দাবি করেন।

সেখানকার কয়েকজন শিশুর সাথে আলাপকালে তারা জানায়, মাল্টা দেয়া হয় এ কথা সত্য, কিন্তু তা পরিমাণে কম থাকায় ভাগ করে খেতে হয়। আবার খাবারের তালিকায় পুষ্টিকর জাতীয় শাক সবজি দিতে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা দেয়ায় যেনো কপাল খুলেছে উপ-পরিচালকের। সস্তামূল্যের শাক সবজি দিয়েই সপ্তাহ পাড় করছে। এখন সকাল দুপুর আলু ভর্ত্তা আর ডাল, রাতে দেয়া হয় সবজি। সপ্তাহে দুইদিন দুপুরে মাছ-মাংস চলেও পোল্ট্রি মুরগির মাংস প্রাধান্য দেয়া হয়।
নিম্নমানের চাল দিয়ে ভাত অথবা খেচুরী সরবাহরের বিষয় বর্তমানে স্টোরের দায়িত্বে থাকা রত্ন রায় জানান, চালের বস্তা খুলে মান পরীক্ষা করা হয় না এ কথা সঠিক। তবে বার্বুচীদের জানানো হয়েছে নিম্নমানের চাল অথবা ডাল পাওয়া গেলে তা অবহিত করতে। এ পর্যন্ত রন্ধনসালা থেকে বার্বুচীদের কাছ থেকে এধরণের অভিযোগ পাওয়া যায়নি বলে এই কর্মকর্তা দাবি করেন। তাহলে খেচুরীর মান নিম্ন কেনো সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে ব্যাস্ততা দেখিয়ে উপ-পরিচালকের সাথে এ প্রসঙ্গে আলাপের পরামর্শ দেন।

আয়া সীমা বেগম এতো ক্ষমতা পেলো কোথায়? তার উৎস খুঁজতে গিয়ে জানা গেলো উপ-পরিচালক বাসু দেবনাথের সাথে এই চর্তুথ শ্রেণির কর্মচারীর সখ্যতার কারণে আয়া পদবী থেকে তিনি এখন অনেক কিছুই দেখাশোনা করেন। ইতোমধ্যে সীমা বেগম উপ-পরিচালকের খাস লোক হিসেবে পরিচিত পাওয়ায় তার চলার পথে কেউ বাধা সৃষ্টির সাহস পাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে সেলফোনে উপ-পরিচালক বাসু দেবনাথের সাথে কথা হলে তিনি অভিযোগসমূহ অস্বীকার করে বলেন, শেখ রাসেল শিশু পূনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তার দায়িত্বকালে কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই। তাহলে চালের মান নিম্ন কেনো এবং শাক সবজি মিশ্রত পুষ্টিকর খেচুরী তৈরিতে এই ধরণের উপকরণের বদলে হলুদ রঙ্গে রঙিন কেনো? এর উত্তরে বললেন আগামীকাল বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।
সেখানে অবস্থানরত ৯২জন বালক ৯০জন বালিকা করোনা ভাইরাসে কিভাবে মুক্ত থাকবেন তার কোন নির্দেশনাও দেয়া হয়নি বলে শিশুরাই এই অভিমত ব্যক্ত করেন। কোন এক শিশু জানান, সামাজিক দূরাত্ব বজয় রেখে চলা ফেরা কথা টেলিভিশনে শোনা গেলে ভিতরে তারা গাদা গাদি করে থাকতে হচ্ছে। মাস্ক এবং হ্যান-স্যানিটাজার বিভিন্ন সংস্থা বিনামূল্যে দিয়ে গেলেও তা সরকারি খাতায় ক্রয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কি না তা নিয়ে সন্দহে করা হয়েছে। এসব অনিয়মের কথা বাইরে প্রকাশ করলে এখানে কারাগারের ন্যায় নির্যাতন অথবা বের করে দেয়ার অযুহাত তৈরির অতীত উদাহরণ থাকায় তাদের নির্বাক থাকতে হচ্ছে নিরুপায় হয়ে। মানতে হচ্ছে এক আয়ার অদৃশ্য শক্তির দাপট।

 

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
error: এই সাইটের নিউজ কপি বন্ধ !!
Website Design and Developed By Engineer BD Network