আপডেট: নভেম্বর ১৫, ২০২৪
আপডেট নিউজ ডেস্ক ::গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হারানোর তিন মাসেরও বেশি সময় কেটে গেছে। তবে নিজেদের কৃতকর্ম নিয়ে দলটির কোনো অনুশোচনা দেখা যাচ্ছে না।বিশেষ করে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলন দমনে যেভাবে শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে এবং তাতে যত প্রাণহানি হয়েছে, সেই দায় স্বীকার করে এখনো দলটিকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। দলটির শীর্ষ নেতারা এখনো বিশ্বাস করেন করেন, গণঅভ্যুত্থানের নামে ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের’ মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
ছাত্র আন্দোলন নিয়ে গত ২৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এটা যে একটা বিরাট চক্রান্ত, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। ’ ক্ষমতা হারানোর তিন মাস পরও আওয়ামী লীগ একই সুরে কথা বলছে।
‘এটি (গণঅভ্যুত্থান) যে একটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল, তা ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে,’ বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সরকারবিরোধিতায় রূপ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি বিদেশি শক্তিরও ভূমিকা রয়েছে।সাবেক নৌপ্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলছিলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে, তারাই এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। ’
দায় নিতে চায় না আওয়ামী লীগ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে গত জুলাই-আগাস্টে শেখ হাসিনার সরকার যেভাবে বলপ্রয়োগ করে এবং তাতে যত মানুষ হতাহত হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে ইতিহাসে সেটি নজিরবিহীন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, আন্দোলন চলাকালে তিন সপ্তাহে সাড়ে আট শতাধিক বেশি মানুষ নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই মারা যান গুলিতে।
এ ছাড়া আহত হন ২০ হাজারেরও বেশি। তাদের মধ্যে অনেকেই হাত, পা এবং চোখ হারিয়েছেন; পঙ্গুত্বও বরণ করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু হতাহতের এসব ঘটনার পুরো দায় নিতে চায় না আওয়ামী লীগ।
‘শুরু থেকেই আমরা বলে আসছিলাম যে, এই আন্দোলনে একটি তৃতীয়পক্ষ রয়েছে, যাদের গুলিতে সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে,’ বলেন নাছিম।
আওয়ামী লীগ এসব কথা বললেও পুলিশ, বিজিবি ও দলটির বন্দুকধারী নেতাকর্মীরা যে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালান, অসংখ্য ছবি ও ভিডিও তখনই সামনে আসে।
‘কিছু ভুল-ত্রুটি তো ছিলই’
আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে বড় একটি অভিযোগ ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে, ওই সময় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে অন্তত এক হাজার ৯২৬ জন মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন।
এর বাইরে, অসংখ্য মানুষ গুমের শিকার হন, যাদের কেউ কেউ শেখ হাসিনার পতনের পর এখন ফিরেও আসছেন। যদিও গুম হওয়া ব্যক্তিদের একটি বড় অংশের এখনো কোনো সন্ধান পায়নি পরিবার। এর বাইরে, অনিয়ম-দুর্নীতি, জমি দখল, বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারসহ আরও অনেক অভিযোগ সামনে এসেছে।
আওয়ামী লীগের গত তিন মেয়াদের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছরে গড়ে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
অর্থ পাচার করে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের অনেকে বিদেশে বিপুল সম্পত্তির মালিকও হয়েছেন।
‘আওয়ামী লীগ তো আসমান থেকে আসা কোনো দল নয়। আমরা সবাই মানুষ। কাজেই দেশ পরিচালনার সময় কিছু ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কিছু ভুল-ত্রুটি তো ছিলই,’ বলেন বাহাউদ্দিন নাছিম।
‘আত্মগোপনে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না’
গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা আকস্মিকভাবে ভারতে চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রীতিমত দিশেহারা হয়ে পড়েন। এর মধ্যেই জনক্ষোভের মুখে বিভিন্ন স্থানে দলটির কার্যালয়, নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে।
গত তিন মাসে ‘আত্মগোপনে’ থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। কেউ কেউ দেশও ছেড়েছেন। অনেকে আত্মগোপনে রয়েছেন। নাছিমের দাবি, ‘আত্মগোপনে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ’
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দুই শতাধিক মামলা হয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগই হত্যা মামলা। একইভাবে, দলটির অন্যান্য নেতাকর্মীদেরকেও অসংখ্য মামলায় আসামি করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী অবশ্য এসব মামলাকে ‘বানোয়াট ও ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করছেন। জুলাই থেকে গত চার মাসে হামলায় দলটির কয়েকশ নেতাকর্মী নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে আওয়ামী লীগ।
সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা দিয়ে সম্প্রতি আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাতিল করা হয়েছে ১৫ আগস্ট শোক দিবস, সংবিধান দিবসসহ জাতীয় আটটি দিবস।
এখন গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগ সভাপতিসহ অন্য নেতাদের বিচার করার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। এমনকি দল হিসেবে আওয়ামীকে নিষিদ্ধও করারও দাবি করছেন অনেকে।
‘এগুলোর সবই ষড়যন্ত্রের অংশ,’ বলছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যেই এসব করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে থাকা নেতাদের মধ্যে যোগাযোগের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘নিয়মিতভাবেই এখন আমাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ হচ্ছে, আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। ’
এমনকি তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার একাধিক ফোনালাপও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। যদিও ফোনালাপগুলোর আসল কি না, বিবিসির পক্ষে স্বাধীনভাবে সেটি যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
দলীয় সভাপতির সঙ্গে যে যোগাযোগ হচ্ছে, তা অবশ্য স্বীকার করছেন নেতারা। খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শুধু নেতাদের সঙ্গেই নয়, সাধারণ কর্মী ও মানুষের সঙ্গেও আমাদের নেত্রীর যোগাযোগ রয়েছে।
সামনে কী?
গত ১০ নভেম্বর ঢাকার গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে নূর হোসেন দিবস পালনের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। যদিও দলটির কর্মী-সমর্থকদের সেভাবে মাঠে নামতে দেখা যায়নি।
সাম্প্রতিক এ কর্মসূচির মাধ্যমে দলকে সংগঠিত করার পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার, সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দল কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেটিও বুঝতে চেয়েছে আওয়ামী লীগ।
তবে আপাতত সরকারবিরোধী বড় কোনো কর্মসূচিতে যাওয়ার পরিকল্পনা দলটির নেই বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন নেতারা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাছিম বলেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনায় যে ধরনের কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন, সেটিই আমরা নেব। ’
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক বাংলা গণমাধ্যম চ্যানেল এসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কখনো ফুরিয়ে যায়নি, আওয়ামী লীগ ফুরিয়ে যাবেও না। আওয়ামী লীগ সচেতনভাবেই এখন চুপ আছে। ’
অন্তর্বর্তী সরকার কখন ব্যর্থ প্রমাণিত হয়, দলটি এখন সেই অপেক্ষায় রয়েছে। দলটির নেতাকর্মীদের কথায় এমন ইঙ্গিতই মেলে।
আওয়ামী লীগ নেতা খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দেশের ক্ষতি করার জন্য এরা যে মিথ্যা বলে ও ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করেছে, সেটা জনগণ বুঝে গেছে।
তৃণমূলের নেতাকর্মীরা কী বলছেন?
গণঅভ্যুত্থানের পর হামলার ভয়ে দেশের বেশিরভাগ এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গা ঢাকা দেন। গত তিন মাসে পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত হয়ে আসায় তাদের কেউ কেউ নিজ এলাকায় ফিরতে শুরু করেছিলেন।
কিন্তু সম্প্রতি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি ঘোষণার পর আবারও ঘর ছাড়তে হয়েছে বলে জানাচ্ছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, ‘নিজেরা নিরাপদে থেকে বিদেশে বসে বসে নেতারা যে কর্মসূচি ঘোষণা করছেন, তারা কি আমাদের কথা ভাবেন? ভেবে থাকলে এমন কর্মসূচি তারা এখন কীভাবে দেন?’
একই সুরে কথা বলেন তৃণমূলের অন্য নেতারাও। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তারা দলীয় কোনো কর্মসূচিতেই অংশ নেবেন না বলে জানান।
দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘দলের জন্য যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছি। তাতে লাভ কী হয়েছে? মার খাই আমরা, রক্ত দিই আমরা, আর হাইব্রিড নেতারা এসে অর্থ-সম্পদের মালিক হন। ’
তারা দুজনই মনে করেন যে, জুলাই-অগাস্টের ছাত্র আন্দোলন দমনে সরকার ও দলের বিতর্কিত ভূমিকার জন্য আওয়ামী লীগের দুঃখপ্রকাশ করা উচিত। তৃণমূলের নেতারা কেউই তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরিন বলেন, রাজনীতিতে ফিরে আসতে হলে আওয়ামী লীগকে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই ফিরে আসতে হবে। আর সেজন্য কর্তৃত্ববাদী শাসনের চালানোর জন্য ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের ক্ষমা চাওয়া উচিত।
আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ক্ষমা চাইলে তো এদেশের মানুষ ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এখনও ক্ষমা চায়নি এবং চাইবে বলেও মনে হচ্ছে না। কারণ ক্ষমা চাইলে তাদের রাজনীতিটা আর থাকে না।পালনের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। যদিও দলটির কর্মী-সমর্থকদের সেভাবে মাঠে নামতে দেখা যায়নি।
সূএ-বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন