আপডেট: অক্টোবর ২৮, ২০২৫
মোহাম্মদ ইউসুফ (নিজস্ব প্রতিবেদক):
ভয়াল ও রক্তাক্ত সেই ২৮ অক্টোবর আজ। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে হৃদয়বিদারক ও কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয়েছে ২০০৬ সালের এই দিনে। রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকায় প্রকাশ্যে লগি–বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের ছয় নেতাকর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
২০০৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানের মহাসমাবেশ থেকে শেখ হাসিনা তার কর্মীদের লগি, বৈঠা নিয়ে ঢাকা অবরোধের আহবান জানিয়েছিলেন। তার এই আহবানে সাড়া দিয়েই আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের কর্মীরা লগি বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ২৭ অক্টোবর বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই ঢাকাসহ সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ২৮ অক্টোবরের ঘটনা ছিল শেখ হাসিনার নির্দেশেরেই চূড়ান্ত ফসল।
লগি, বৈঠা, লাঠি, পিস্তল ও বোমা হামলা চালিয়ে যেভাবে মানুষ খুন করা হয়েছে তা মনে হলে আজও শিউরে ওঠে সভ্যসমাজের মানুষ। একটি মানুষকে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করার পর তার ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে উল্লাস করার ঘটনা মানুষ নামের কোনো প্রাণী সমর্থন করতে পারে না। সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ মেরে লাশের ওপর নৃত্য উল্লাস করার মতো ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। দিনে দুপুরে শত শত ক্যামেরা আর হাজার হাজার মানুষের সামনে দেখা গেল প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ছে। গুলির আঘাতে কয়েকজনের মাথা, বুক, হাত-পা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মাথা কয়েক খণ্ড করা হয়েছে, এমনকি মাথার একাংশ ঝুলে গেছে, মাথা ফেটে মগজ পর্যন্ত বেরিয়ে গেছে। সমস্ত শরীরে মারাত্মক জখম এবং হাত-পায়ের হাড় ভেঙে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। নির্মম আঘাতে অনেকের চেহারাও বিকৃত হয়ে গেছে। অনেকের দাঁত পড়ে গেছে। ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গেলেও হায়েনাদের হৃদয় একটুও গলেনি।
শিবির নেতা হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপনকে হাত ধরে পাল্স পরীক্ষা করে মুখ নড়ে ওঠায় বাঁশের মাথা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দাঁতগুলোকে মাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। কোনো মানুষ নামের জীবের পক্ষে এ কী করে সম্ভব? আরেক শিবির নেতা মাসুমকে ইটের আঘাতে মাথার ভেতর ইটের টুকরা ঢুকিয়ে তার মগজকে এবড়ো থেবড়ো করে দিলে জ্ঞান হারানো অবস্থায় তিন দিন পর পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। শিবির নেতা মুজাহিদ এবং জামায়াত কর্মী জসিমকে বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে রাস্তার সাথে মিশিয়ে দেয়, আধমরা করে আবার দাঁড় করানো হয়, আবার পেটাতে পেটাতে মাটিতে শুইয়ে দেয় হয়, আবার ওঠায় আবার পেটায়।
সিদ্ধিরগঞ্জে লগি-বৈঠার আঘাত থেকে ভাইকে বাঁচাতে ভাইয়ের গায়ের ওপর শুয়ে পড়লে হায়েনাদের আঘাতে আঘাতে সবাইকে ছেড়ে চলে যায় বাবা হারা পরিবারের দায়িত্বে থাকা আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল। যারা মাত্র ২ দিনে ২৬ জন জীবন্ত মানুষকে এমন নির্মমভাবে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করলো তারা কি মানুষ নাকি পশু? আর যারা এহেন কাজের নির্দেশ দিয়েছিল এবং পক্ষ নিয়েছিল তারা কী? ওরা আসলে মানুষের চেহারায় হিংস্র জানোয়ার, ওরা খুনি, ওরা হায়েনা, ওরা রক্তপিপাসু। এরাই প্রকৃত মানবতাবিরোধী।
এ ঘটনা শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের হৃদয় নাড়া দিয়েছে। তবে সেদিন বাংলাদেশের ডান বাম সকল বড় বড় সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদ আইনজীবীরা ঐ ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছিলেন এবং বিচারও দাবি করেছিল। শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো পৃথিবীতে সেদিনের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ নিন্দা জানিয়েছেন।
২৮ অক্টোবর আওয়ামী নরপশুরা যেভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষকে হত্যা করেছিল আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে এই রকম আরেকটি ঘটনা বিরল। কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে আওয়ামী লীগের এমন জঘন্য ইতিহাস নতুন হলেও আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক জীবনের তার পুনরাবৃত্তি করেছে অসংখ্যবার। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণেই আওয়ামী লীগ সিরাজ শিকদারসহ ৪০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যার জঘন্য ইতিহাস তৈরি করেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে সংসদের স্পিকার ও সংসদ সদস্য হত্যার খারাপ দৃষ্টান্ত সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে আওয়ামী লীগই ঘটিয়েছে। তবে বিগত জুলাই বিপ্লবে প্রায় মাসখানেক ধরে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সারাদেশে চালানো তাদের নৃশংস তান্ডবের ফলে বর্তমান প্রজন্মের কাছেও আওয়ামী লীগের চরিত্র আজ স্পষ্ট।

