আপডেট: ডিসেম্বর ৩১, ২০২৫
আপডেট নিউজ ডেস্ক:: বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস যেন আজ এক গুমোট কান্নায় ভারী হয়ে আছে। দীর্ঘ ৪৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম, আপসহীন নেতৃত্ব আর কোটি মানুষের ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন করে ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী নাম লিখিয়ে চিরবিদায় নিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের জিয়া উদ্যানে, তাঁর প্রিয় স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শায়িত হলেন এই মহীয়সী জননী। এই দাফনের মধ্য দিয়ে কেবল একজন নেত্রীর প্রস্থান ঘটল না, বরং বাংলাদেশের রাজনীতির এক সুবিশাল ও বর্ণিল অধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটল।বুধবার দুপুর হওয়ার আগেই ঢাকা শহর যেন এক অচেনা স্তব্ধতায় ডুবে যায়। রাজধানীর কেন্দ্রস্থল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ পরিণত হয়েছিল এক বিশাল শোকের মোহনায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত প্রতিটি জনপদ থেকে আসা লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল প্রিয় নেত্রীকে শেষবারের মতো দেখতে। বেলা দুইটায় জানাজা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকেই সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। এই জনস্রোত খামারবাড়ি, ফার্মগেট, আসাদগেট ছাড়িয়ে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। মানুষের পরনে ছিল কালো ব্যাজ, হাতে ছিল শোকের ব্যানার, আর চোখে ছিল জল।বিকেল ৩টার ঠিক পরেই শুরু হয় জানাজা। জানাজায় ইমামতি করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেক। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম জানাজা। দল-মতনির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ এতে শরিক হন।
জানাজার কাতারে দাঁড়িয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁদের সাথে ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং বিদেশি কূটনীতিকরা। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার সরদার আয়াজ সাদিকের উপস্থিতি প্রমাণ করেছে যে, বেগম জিয়ার প্রয়াণ কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং এই অঞ্চলের জন্য এক বিশাল ক্ষতি।
জানাজা শুরুর ঠিক আগে এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয় যখন মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ান মরহুমার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ করে তিনি সমবেত জনগণের উদ্দেশে বলেন, আমি মরহুমা বেগম খালেদা জিয়ার বড় সন্তান তারেক রহমান। আমার মা জীবিত থাকা অবস্থায় যদি আপনাদের কারো কাছ থেকে কোনো ঋণ নিয়ে থাকেন, দয়া করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, আমি তা পরিশোধের ব্যবস্থা করব। একই সঙ্গে তাঁর কোনো ব্যবহারে বা কথায় কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন, আমি তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সন্তানের এই বিনীত আকুতি উপস্থিত লাখো মানুষের হৃদয়ে হাহাকার বাড়িয়ে দেয়। অনেকেই তখন শব্দ করে কেঁদে ওঠেন।
বিকেল সাড়ে ৪টার পর কফিন বহনকারী গাড়িটি পৌঁছায় শেরে বাংলা নগরের জিয়া উদ্যানে। সেখানে সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিউগলের করুণ সুরে তোপধ্বনির মাধ্যমে তাঁকে শেষ বিদায় জানানো হয়।
দাফন প্রক্রিয়া শুরু হলে প্রথমে কবরের ওপর মাটি ছিটিয়ে দেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান। এরপর একে একে পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও শামিলা রহমান এবং নাতনি জাইমা রহমানসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা কবরে মাটি দেন। এরপর তিন বাহিনীর প্রধানগণ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান এবং নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান মরহুমার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে কবরে মাটি দেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা অশ্রুসিক্ত চোখে প্রিয় নেত্রীর দাফন কাজ তদারকি করেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে শাহাদাত বরণ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। সে সময় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে যে বিশাল জানাজা হয়েছিল, ঠিক ৪৪ বছর পর ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর একই স্থানে তাঁর সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়ার জানাজায় মানুষের সেই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ইতিহাসের এক বিরল পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। এই দীর্ঘ ৪৪ বছরে বেগম জিয়া নিজেকে কেবল জিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে নয়, বরং নিজের বলিষ্ঠ ও আপসহীন নেতৃত্বে এদেশের কোটি মানুষের ‘দেশমাতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
গত ২৩ নভেম্বর থেকে বেগম খালেদা জিয়া রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। লিভার সিরোসিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় তাঁর শারীরিক অবস্থা ছিল চরম সংকটময়। হাসপাতালের আইসিইউতে তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত ছিল লড়াইয়ের। অবশেষে ৩০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ভোর ৬টায় সকল পার্থিব মায়া ত্যাগ করে তিনি পাড়ি জমান পরপারে। তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে দেশের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় শোকের মাতম শুরু হয়। সরকার তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক এবং ৩১ ডিসেম্বর সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে।
দাফন শেষে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, তখন শেরে বাংলা নগরের বাতাস দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে। প্রিয় নেত্রীকে কবরে রেখে ফিরে যাওয়ার সময় হাজার হাজার কর্মীর মুখে ছিল এক নীরব হাহাকার। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান তাঁর বক্তব্যে যথার্থই বলেছিলেন, দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসা ছিল আকস্মিক, কিন্তু দেশের প্রয়োজনে তিনি ছিলেন অপরিহার্য।
অমরত্বে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজ আর আমাদের মাঝে শারীরিকভাবে নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আপসহীন সংগ্রামের আদর্শ, বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষার চেতনা এবং দেশপ্রেমের মহিমা প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে অম্লান থাকবে। তিনি শুয়ে আছেন তাঁর প্রিয় স্বামীর পাশে, যেখানে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই, কোনো কারাবন্দিত্ব নেই, কোনো জরা নেই। বাংলাদেশ তাঁর এই মহাপ্রয়াণে এক মহান অভিভাবককে হারালো, যার শূন্যতা কোনোদিনই পূরণ হওয়ার নয়।শান্তিতে ঘুমান হে জননী, বাংলাদেশ আপনাকে কোনোদিন ভুলবে না।

