২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্কে আশা জাগিয়েছে ‘নীলগাই’

আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২১

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন

আপডেট নিউজ, গাজীপুর: প্রায় ৮০ বছর আগে ১৯৪০ সালে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে এক সময় অবাধ বিচরণ ছিল নীলগাইয়ের।
বনাঞ্চল উজাড় হওয়া, বসবাসের পরিবেশ হারানো, খাদ্য সংকট ও শিকারীর অবাধ শিকারের কারণে পরিবেশে প্রাণীটির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে কমতে নীলগাইয়ের নাম বিলুপ্ত হয়ে যায় বলে জানায় বনবিভাগ। তবে পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান নেপাল ও যুক্তরাষ্ট্রে নীলগাই রয়েছে।
বাংলাদেশে বিলুপ্তর তালিকায় থাকা নীলগাই গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কে রয়েছে মাত্র দু’টি। এর মধ্যে একটি পুরুষ ও একটি মাদী নীলগাই। এর বাইরে দেশে আর কোথাও এ প্রাণী নেই।
গত ১ আগস্ট সাফারী পার্কে থাকা নীলগাই থেকে দুটি নীল গাইয়ের জন্ম হয়েছে। তবে নবজাতক দুটি মাদী না পুরুষ তা এখনো নির্ণয় করা যায়নি। আর নতুন জন্ম নেয়া শাবক দুটি থেকেই পার্ক কর্তৃপক্ষ প্রায় ৮০ বছর আগে বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া বিলুপ্তর তালিকায় থাকা নীলগাই প্রকৃতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখছেন। তবে, নতুন জন্ম নেয়া শাবকের নিরাপত্তা ও প্রকৃতিতে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করে বন বিভাগ।
পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান জানান, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা গ্রামের মামুদপুর-ঠুঠাপাড়া বর্ডার এলাকার বাসিন্দারা একটি নীল গাই ধরে জবাই করার প্রস্তুতি নেয়। পরে বিজিবি-৫৩ (মামুদপুর বিওপির) সদস্যরা ওই মাদী নীলগাইকে উদ্ধার করে, রাজশাহীর বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগে হস্তান্তর করলে নীলগাইটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কে আনা হয়।
অপরদিকে, ২০১৯ সালের ২২জানুয়ারি নওগাঁর মান্দা উপজেলার জোতবাজার এলাকায় অপর একটি নীলগাই আটক করে জবাই করার প্রস্তুতি নেয়া হয়। পরে রাজশাহীর বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ স্থানীয় উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় জবাই করার প্রস্তুতির সময় একটি পুরুষ নীলগাই উদ্ধার করে। পরে স্থানীয় ভাবে চিকিৎসা দিয়ে ২০১৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের রামসাগর জাতীয় উদ্যানে স্থানান্তর করা হয়। পরে সেখান থেকে পুরুষ নীলগাইটি প্রজননের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কে আনা হয়।
পার্কের ওয়াইল্ডলাইফ সুপারভাইজার মো. সারোয়ার হোসেন খান জানান, হেমন্ত থেকে শীতকালের শুরুর দিক পর্যন্ত সময়ে তুলনামূলক বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন পুরুষ নীলগাই সম্মতিসূচক লেজ নাড়াচাড়ার পর মাদী নীলগাইয়ের সাথে মিলিত হয়। প্রতিযোহিতার মাধ্যমে পুরুষ নীলগাই একাধিক মাদী নীলগাইয়ের সাথে মিলিত হয়ে থাকে। গর্ভধারণ কাল গড় ২৪৩ দিন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে যমজ বাচ্চা প্রসব করে, ক্ষেত্র বিশেষে একটি থেকে তিনটি বাচ্চাও প্রসব করে থাকে। জন্মের ৪০মিনিটের ভেতর দাঁড়াতে পারে পুরুষ শাবক তিন বছর এবং মাদী দুই বছরে প্রজননক্ষম হয়ে উঠলেও এদের গড় আয়ু ২১ বছর।
তিনি আরো জানান, পুরুষ নীলগাইয়ের বর্ণ গাঢ় ধুসর, অনেকটা কালচে রঙের। অনেক সময় নীলচে আভা দেখা যায় বলে এদের নীলগাই নামকরণ করা হয়েছে। শুধুমাত্র পুরুষ নীলগাইয়ের দুটি কৌনিক, মসৃণ ও সামনের দিকে কিঞ্চিত বাকানো দুটি শিং আছে। পুরুষের উচ্চতা ৫২ থেকে ৫৮ইঞ্চি, শিং এর দৈর্ঘ্য ৮ থেকে ১২ইঞ্চি। মাদী নীলগাই এবং শাবকের রং লালচে বাদামী কিন্তু খুরের উপরের লোম সাদা। ঠোঁট, থুতনি, কানের ভেতরের দিক ও লেজের নীচের তলদেশ সাদা। নীলগাই ছোট ছোট পাহাড় আর ঝোপ-জঙ্গলপূর্ণ মাঠে চড়ে বেড়াতে ভালবাসে। ঘন বন এড়িয়ে চলে। সচরাচর চার থেকে ১০ সদস্যের দল নিয়েই নীলগাই ঘুরে বেড়ায়। দলে কখনো ২০ বা তার বেশি সদস্যও থাকতে পারে।
নীলগাই সম্পর্কে তিনি আরো জানান, নীলগাই গাছে ঢাকা উঁচু-নিচু সমতলে বা তৃণভূমিতে যেমন স্বাচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারে, তেমনি আবার শস্যক্ষেত্রে নেমে ব্যাপক ক্ষতি করতে পটু। সকাল আর বিকেলে খাওয়ার পাট চুকিয়ে দিনের বাকি সময়টা গাছের ছায়ায় বসে কাটায়। মহুয়া গাছের রসালো ফুল এদের দারুণ পছন্দ। পানি ছাড়া এরা দীর্ঘসময় কাটিয়ে দেয়, এমনকি গরমের দিনেও এরা নিয়মিত পানি খায় না। আত্মরক্ষার প্রধান উপায় দৌড়ে পালানো। দ্রুতগামী ও শক্তিশালী ঘোড়ার পিঠে না চড়ে নীলগাই ধরা প্রায় অসম্ভব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো: জাহিদুল কবির বলেন, উদ্ধারকৃত স্ত্রী ও পুরুষ নীলগাইকে জবাই করার আগ মুহূর্তে উদ্ধার করা হয়। সেহেতু বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়ার কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। প্রায় দীর্ঘ ৮০ বছর পর ভারত থেকে আসা নীলগাই বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর তাদের গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কে আনা হয়। এরা জুঁটি বাধার ১১মাস ১১দিন পর গত ১ আগষ্ট দুটি ফুটফুটে বাচ্চা জন্ম দেয়। বর্তমানে সবাই সুস্থ আছে। বাংলাদেশ নীলগাই শূণ্য হলেও ভারতে লাখের উপর নীলগাই রয়েছে। সাফারী পার্কে সংরক্ষিত নীলগাই দুটি ভারত সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করার পর সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের কাছ জবাই করার পূর্ব মুহূর্তে উদ্ধার করা হয়। আর যদি ১০থেকে ২০ মিনিট দেরি হতো তাহলে মাংসের জন্য নীলগাই দুটি জবাই হয়ে যেতো।
বাংলাদেশের শেষ নীলগাইটিকে এভাবেই হত্যা করা হয়েছে এবং প্রায় ৮০বছর আগেই আমরা প্রকৃতি থেকে নীলগাইয়ের সমাপ্তি টেনেছিলাম। আশি বছর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কের দুইটি নীল গাই বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। আমরা আশা করছি বিলুপ্তর তালিকায় থাকা নীলগাই গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কের মাধ্যমে আবারো প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিরে আসবে।

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
error: এই সাইটের নিউজ কপি বন্ধ !!
Website Design and Developed By Engineer BD Network